Thursday, 27 October 2016

জন্মেছি এই দেশে

সুফিয়া কামাল---সংকলিত (সুফিয়া কামাল)
অনেক কথার গুঞ্জন শুনি
অনেক গানের সুর
সবচেয়ে ভাল লাগে যে আমার
‘মাগো’ ডাক সুমধুর।

আমার দেশের মাঠের মাটিতে
কৃষাণ দুপুরবেলা
ক্লান্তি নাশিতে কন্ঠে যে তার
সুর লয়ে করে খেলা।

মুক্ত আকাশে মুক্ত মনের
সেই গান চলে ভেসে
জন্মেছি মাগো তোমার কোলেতে
মরি যেন এই দেশে।

এই বাংলার আকাশ-বাতাস
এই বাংলার ভাসা
এই বাংলার নদী, গিরি-বনে
বাঁচিয়া মরিতে আশা।

শত সন্তান সাধ করে এর
ধূলি মাখি সারা গায়
বড় গৌরবে মাথা উচু করি
মানুষ হইতে চায়।

Tuesday, 25 October 2016

আকাশলীনা

জীবনানন্দ দাশ---সাতটি তারার তিমির
সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।

কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ:
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।

সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস -
আকাশের ওপারে আকাশ।

কবিতা আশ্বিন ১৩৪৪

বুনো হাঁস

জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে-
জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহবানে

বুনো হাঁস পাখা মেলে- শাঁই শাঁই শব্দ শুনি তার;
এক-দুই-তিন- চার-অজস্র-অপার-
রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া
এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে-ছুটিতেছে তারা।

তারপর পড়ে থাকে, নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,
হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ-দু-একটা কল্পনার হাঁস;

মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা স্যানালের মুখ;
উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক

কল্পনার হাঁস সব — পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রঙ মুছে গেল পর
উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর ।

হিন্দু - মুসলিম


জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে-পুণ্য ভারতপুরে
পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে নমাজের সুরে সুরে!
আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলার মাঝে,
মুয়াজ্জেনের উদাস ধ্বনিটি গগনে গগনে বাজে,
জপে ঈদগাতে তসবি ফকির, পূজারী মন্ত্র পড়ে,
সন্ধ্যা-উষার বেদবাণী যায় মিশে কোরানের স্বরে;
                                     সন্ন্যাসী আর পীর
মিলে গেছে হেথা,-মিশে গেছে হেথা মসজিদ , মন্দির!

কে বলে হিন্দু বসিয়া রয়েছে একাকী ভারত জাঁকি?
-মুসলমানের হস্তে হিন্দু বেঁধেছে মিলন-রাখী;
আরব মিশর তাতার তুর্কী ইরানের চেয়ে মোরা
ওগো ভারতের মোসলেমদল,- তোমাদের বুক-জোড়া!
ইন্দ্রপ্রস্থ ভেঙেছি আমরা,- আর্যাবর্ত ভাঙি
গড়েছি নিখিল নতুন ভারত নতুন স্বপনে রাঙি!
                                       -নবীন প্রাণের সাড়া
আকাশে তুলিয়া ছুটিছে মুক্ত যুক্তবেণীর ধারা!

রুমের চেয়েও ভারত তোমার আপন,- তোমার প্রাণ!
-হেথায় তোমার ধর্ম অর্থ,- হেথায় তোমার ত্রাণ;
হেথায় তোমার আসান ভাই গো, হেথায় তোমার আশা;
যুগ যুগ ধরি এই ধূলিতলে বাঁধিয়াছ তুমি বাসা,
গড়িয়াছ ভাষা কল্পে কল্পে দরিয়ার তীরে বসি,
চক্ষে তোমার ভারতের আলো,-ভারতের রবি, শশী,
                                   হে ভাই মুসলমান,
তোমাদের তরে কোল পেতে আছে ভারতের ভগবান!

এ ভারতভূমি নহেকো তোমার, নহকো আমার একা,
হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ,- মুসলমানের রেখা;
-হিন্দু মনীষা জেগেছে এখানে আদিম উষার ক্ষণে,
ইন্দ্রদ্যুম্নে উজ্জয়িনীতে মথুরা বৃন্দাবনে!
পাটলিপুত্র শ্রাবস্তী কাশী কোশল তক্ষশীলা।
অজন্তা আর নালন্দা তার রটিছে কীর্তিলীলা!
                                     -ভারতী কমলাসীনা
কালের বুকেতে বাজায় তাহার নব প্রতিভার বীণা!

এই ভারতের তখতে চড়িয়া শাহানশাহার দল
স্বপ্নের মণি-প্রদীপে গিয়েছে উজলি আকাশতল!
-গিয়েছে তাহার কল্পলোকের মুক্তার মালা গাঁথি,
পরশে তাদের জেগেছে আরব- উপন্যাসের রাতি!
জেগেছে নবীন মোগল-দিল্লি,-লাহোর,-ফতেহপুর,
যমুনাজলের পুরানো বাঁশিতে বেজেছে নবীন সুর!
                                 নতুন প্রেমের রাগে
তাজমহলের তরুণিমা আজো ঊষার আরুণে ‌জাগে!

জেগেছে হেথায় আকবরী আইন,-কালের নিকষ কোলে
বারবার যার উজল সোনার পরশ উঠিল জ্বলে!
সেলিম,-শাজাহাঁ,- চোখের জলেতে এক্‌শা করিয়া তারা
গড়েছে মীনার মহলা স্তম্ভ কবর ও শাহদারা!
-ছড়ায়ে রয়েছে মোঘল ভারত,- কোটি সমাধির স্তূপ          
তাকায়ে রয়েছে তন্দ্রাবিহীন,-অপলক অপরূপ!
                                 -যেন মায়াবীর তুড়ি
স্বপনের ঘোরে ত্বব্ধ করিয়া রেখেছে কনকপুরী!

মোতিমহলের অযুত রাত্রি,- লক্ষ দীপের ভাতি
আজিও বুকের মেহেরাবে যেন জ্বালায়ে যেতেছে বাতি!
-আজিও অযুত বেগম-বাঁদীর শষ্পশয্যা ঘিরে
অতীত রাতের চঞ্চল চোখ চকিতে যেতেছে ফিরে!
দিকে দিকে আজো বেজে ওঠে কোন্‌ গজল-ইলাহী গান!
পথ-হারা কোন্‌ ফকিরের তানে কেঁদে ওঠে সারা প্রাণ!
                                   -নিখিল ভারতময়
মুসলমানের স্বপন-প্রেমের গরিমা জাগিয়া রয়!

এসেছিল যারা ঊষর ধুসর মরুগিরিপথ বেয়ে,
একদা যাদের শিবিরে- সৈন্যে ভারত গেছিল ছেয়ে,
আজিকে তাহারা পড়শি মোদের,- মোদের বহিন-ভাই;
-আমাদের বুকে বক্ষে তাদের,-আমাদের কোলে ঠাঁই
‘কাফের’ ‘যবন’ টুটিয়া গিয়াছে,- ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা,
মোস্‌লেম্‌ বিনা ভারত বিফল,- বিফল হিন্দু বিনা;
                                -মহামৈত্রীর গান
বাজিছে আকাশে নব ভারতের গরিমায় গরীয়ান!

ধান কাটা হয়ে গেছে


  1.  জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন

ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন — ক্ষেত মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম — সাপের খোলস নীড় শীত।
এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর
ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ — কেমন নিবিড়।

ওইখানে একজন শুয়ে আছে — দিনরাত দেখা হত কত কত দিন
হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কত অপরাধ;
শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং
আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।

Monday, 24 October 2016

হরিণেরা

জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
স্বপ্নের ভিতরে বুঝি–ফাল্গুনের জ্যোৎস্নার ভিতরে।
দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে

হরিণেরা; রূপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়;
বাতাস ঝরিছে ডানা — মুক্তা ঝ’রে যায়

পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে-বনে বনে-হরিণের চোখে;
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে।

হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে
হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে,–

বিলুপ্ত ধূসর কোন পৃথিবীর শেফালিকা, আহা,
ফাল্গুনের জ্যোৎস্নায় হরিণেরা জানে শুধু তাহা।

বাতাস ঝাড়িছে ডানা, হীরা ঝরে হরিণের চোখে–
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর হীরার আলোকে।

Sunday, 23 October 2016

মহররম



               -কাজী নজরুল ইসলাম

নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া,-
“আম্মা! লা’ল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া!”
কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে!
রুদ্র মাতম্ ওঠে দুনিয়া-দামেশ্ কে-
“জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে?”
“হায় হায় হোসেনা”, ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,
তল্ ওয়ার কেঁপে ওঠে এজিদেরও পঞ্জায় !
উন্মাদ “দুল্ দুল্” ছুটে ফেরে মদিনায়,
আদি-জাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায় !
মা ফতেমা আসমানে কাঁদে খুলি কেশপাশ,
বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেতবাস !
রণে যায় কাসিম ঐ দু’ঘড়ির নওশা,
মেহেদীর রঙটুকু মুছে গেল সহসা !
“হায় হায়” কাঁদে বায় পূরবী ও দখিনা—
“কঙ্কণ পঁইচি খুলে ফেল সকীনা!”
কাঁদে কে রে কোলে ক’রে কাসিমের কাটা-শির ?
খান্ খান্ হয়ে ক্ষরে বুক-ফাটা নীর !
কেঁদে গেছে থামি’ হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,
বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র!
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
“আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা!”
নিয়ে তৃষা সাহারার, দুনিয়ার হাহাকার,
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার!
দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস,
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশমনও “সাব্বাস” !
দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর “শির দেগা,  নেহি দেগা আমামা!”
কলিজা কাবাব সম ভুনে মরু-রোদ্দুর,
খাঁ-খাঁ করে কারবালা, নাই পানি খর্জ্জুর,
মা’র স্তনে দুধ নাই, বাচ্চারা তড়পায় !
জিভ চুষে’ কচি জান থাকে কিরে ধড়টায় ?
দাউ দাউ জ্বলে শিরে কারবালা-ভাস্কর,
কাঁদে বানু—-“পানি দাও, মরে যাদু আসগর !”
পেলো না তো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন,
ডাকে মাতা, পানি দেবো ফিরে আয় বাছা শুন !
পুত্রহীনার আর বিধবার কাঁদনে
ছিঁড়ে আনে মর্মের বত্রিশ বাঁধনে !
তাম্বুতে শয্যায় কাঁদে একা জয়নাল,
“দাদা! তেরি ঘর্ কিয়া বরবাদ পয়মাল!”
“হাইদরী-হাঁক হাঁকি দুলদুল-আসওয়ার
শমশের চমকায় দুষমনে ত্রাস বার।
খ’সে পড়ে হাত হ’তে শত্রুর তরবার,
ভাসে চোখে কিয়ামতে আল্লার দরবার !
নিঃশেষ দুষমন; ও কে রণ-শ্রান্ত
ফোরাতের নীরে নেমে মুছে আঁখি-প্রান্ত ?
কোথা বাবা আসগর? শোকে বুক-ঝাঁঝরা
পানি দেখে হোসেনের ফেটে যায় পাঁজরা!
ধুঁকে ম’লো আহা তবু পানি এক কাৎরা
দেয় নি রে বাছাদের মুখে কম জাত্ রা !
অঞ্জলি হতে পানি পড়ে গেল ঝর্-ঝর্,
লুটে ভূমে মহাবাহু খঞ্জর-জর্জ্জর !
হল্ কুমে হানে তেগ ও কে ব’সে ছাতিতে ?
আফতাব ছেয়ে নিল আঁধিয়ারা রাতিতে ।
“আসমান” ভ’রে গেল গোধূলিতে দুপুরে,
লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে !
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে, আহ্—
“আরশের” পায়া ধরে, কাঁদে মাতা ফাতেমা,
“ এয়্ খোদা বদলাতে বেটাদের রক্তের
মার্জ্জনা কর গোনা পাপী কম্ বখতের ।”
কত মোহররম এলো, গেল চ’লে বহু কাল—
ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল !
মুসলিম! তোরা আজ “জয়নাল আবেদীন” ,
“ওয়া হোসেনা—ওয়া হোসেনা” কেঁদে তাই যাবে দিন !
ফিরে এলো আজ সেই মোহররম মাহিনা,—
ত্যাগ চাই,  মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না!
উষ্ণীষ কোরানের,  হাতে তেগ্ আরবীর,
দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শির,—
তবে শোন ঐ বাজে কোথা দামামা,
শমশের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা!
বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকীবের তুর্য্য,
হুঁশিয়ার ইসলাম, ডুবে তব সূর্য্য!
জাগো ওঠ মুসলিম, হাঁকো হাইদরী হাঁক।
শহীদের দিনে সব লালে-লাল হ’য়ে যাক্!
নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তীন,
ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস্ দিন!
হাসানের মতো পি’ব পিয়ালা সে জহরের,
হোসেনের মতো নিব বুকে ছুরি কহরের ;
আসগর সম দিব বাচ্চারে কোর্ বান,
জালিমের দাদ নেবো,  দেবো আজ গোর জান !
সকীনার শ্বেতবাস দেবো মাতা কন্যায়,
কাসিমের মত দেবো জান রুধি’ অন্যায়!
মোহর্ রম্ ! কারবালা ! কাঁদো “হায় হোসেনা!”
দেখো মরু-সূর্য্যে এ খুন যেন শোষে না!
দুনিয়াতে দুর্ম্মদ খুনিয়ারা ইসলাম!
লোহ লাও, নাহি চাই নিষ্কাম বিশ্রাম!
                                - [অগ্নি-বীণা]

Wednesday, 12 October 2016

বাংলাদেশ
মুহাম্মদ হেলাল উদ্দিন 
'বিশ্বময় বাংলাভাষা' কাব্যগ্রন্হ থেকে নেওয়া
ছবি: 'বাংলাদেশ' কবিতা  


স্বাধীন বাংলাদেশ !

ধরণীর বুকে আকাঙ্ক্ষার ভূমি মোদের,

মোদের চিরায়ত মঞ্জিল ।

ফুল - ফল ও ফসলে রহে আবাদ

জিন্দেগী মোদের শান্তির আস্বাদ,

হিন্দু - মুসলিম সাম্যের মৈত্রী - প্রীতির বন্ধনে

দিকে দিকে হেথা ধ্বনিছে মানবতার কল্যাণ,

মজলুমের স্মৃতির একাত্তরে অম্লান

যারা তলাবিহীন ঝুড়ি,যারা অন্ন হারা

এই মঞ্জিলে আজ খুঁজে পাচ্ছে তারা

--- জীবনের সঞ্চয় অফুরান ।।

অধিকার বিহীন ছিল যারা সীমাহীন,

এ মাটি আজ তাদের স্বপ্ন ফলনে রঙ্গিন।

অবনীর বুকে স্বীকৃত মডেল মোরা আজ,

জীবনের নানা সূচকের লক্ষ্য পূরণের অধিকারে ।

পার্বত্য শৈল কেওকারাডং শীর্ষ,

চিরায়ত জননী মোদের জন্মভূমি,

দুনিয়ার জান্নাত সগৈরবে বুলন্দ।।

নয়ন জুড়ানো সমুদ্র সৌকত

অঙ্গ ধৌত গৌরব শানিত,

পদ্মা - যমুনা -ডাকাতিয়া বাহিত -

স্নিগ্ধ অমৃত ধারা ।

দেশের তরে সারাটি জীবন ভরে

মোরা জাগ্রত কর্মী, মোরা স্বপ্ন পূরণে দৃপ্ত ।

জোনাক জ্বলে উঠে

মুহাম্মদ হেলাল উদ্দিন
চাঁদনী রাতে ঘরের পিছে

গুল্ম - লতার মাঝে

মিট - মিট -মিট আলো ছড়ায়

দৃষ্টিনন্দন সাজে ।

কুমড়ো ফুলে দোয়েল পাখি

ডাকছে খোকায় শেষে,

ঝাঁকে ঝাঁকে সারি সারি

জোনাক জ্বলে উঠে ।

এমনি সময় খোকা বাবু

ঘরের বাইরে এসে

একটি জোনাক ধরে ফেলে

দু' ঠোঁট মিলে হাসে।

Thursday, 6 October 2016

নকশী কাঁথার মাঠ - ৫

জসীম উদদীন
পাঁচ

লাজ-রক্ত হইল কন্যার পরথম যৌবন
— ময়মনসিংহ গীতিকা

আশ্বিনেতে ঝড় হাঁকিল, বাও ডাকিল জোরে,
গ্রামভরা-ভর ছুটল ঝপট লট্ পটা সব করে |
রূপার বাড়ির রুশাই-ঘরের ছুটল চালের ছানি,
গোয়াল ঘরের খাম থুয়ে তার চাল যে নিল টানি |
ওগাঁর বাঁশ দশটা টাকায়, সে-গাঁয় টাকায় তেরো,
মধ্যে আছে জলীর বিল কিইবা তাহে গেরো |
বাঁশ কাটিতে চলল রূপাই কোঁচায় বেঁধে চিঁড়া,
দুপুর বেলায় খায় যেন সে—মায় দিয়াছে কিরা |
মাজায় গোঁজা রাম-কাটারী চক্ চকাচক্ ধার,
কাঁধে রঙিন গামছাখানি দুলছে যেন হার |
মোল্লা-বাড়ির বাঁশ ভাল, তার ফাঁপগুলি নয় বড় ;
খাঁ-বাড়ির বাঁশ ঢোলা ঢোলা, করছে কড়মড় |
সর্ব্বশেষে পছন্দ হয় খাঁ-বাড়ির বাঁশ :
ফাঁপগুলি তার কাঠের মত, চেকন-চোকন আঁশ |

বাঁশ কাটিতে যেয়ে রূপাই মারল বাঁশে দা,
তল দিয়ে যায় কাদের মেয়ে—হলদে পাখির ছা!
বাঁশ কাটিতে বাঁশের আগায় লাগল বাঁশের বাড়ি,
চাষী মেয়ের দেখে তার প্রাণ বুঝি যায় ছাড়ি |
লম্বা বাঁশের লম্বা যে ফাঁপ, আগায় বসে টিয়া,
চাষীদের ওই সোনার মেয়ে কে করিবে বিয়া!
বাঁশ কাটিতে এসে রূপাই কাটল বুকের চাম,
বাঁশের গায়ে বসে রূপাই ভুলল নিজের কাম |
ওই মেয়ে ত তাদের গ্রামে বদনা-বিয়ের গানে,
নিয়েছিল প্রাণ কেড়ে তার চিকন সুরের দানে |

“খড়ি কুড়াও সোনার মেয়ে! শুকনো গাছের ডাল,
শুকনো আমার প্রাণ নিয়ে যাও, দিও আখার জ্বাল |
শুকনো খড়ি কুড়াও মেয়ে! কোমল হাতে লাগে,
তোমায় যারা পাঠায় বনে বোঝেনি কেন আগে?”
এমনিতর কত কথাই উঠে রূপার মনে,
লজ্জাতে সে হয় যে রঙিন পাছে বা কেউ শোনে |
মেয়েটিও ডাগর চোখে চেয়ে তাহার পানে,
কি কথা সে ভাবল মনে সেই জানে তার মানে!

এমন সময় পিছন হতে তাহার মায়ে ডাকে,
“ওলো সাজু! আয় দেখি তোর নথ বেঁধে দেই নাকে!
ওমা! ও কে বেগান মানুষ বসে বাঁশের ঝাড়ে!”
মাথায় দিয়ে ঘোমটা টানি দেখছে বারে বারে |

খানিক পরে ঘোমটা খুলে হাসিয়া এক গাল,
বলল, “ও কে, রূপাই নাকি? বাঁচবি বহকাল!
আমি যে তোর হইযে খালা, জানিসনে তুই বুঝি?
মোল্লা বাড়ির বড়ুরে তোর মার কাছে নিস্ খুঁজি |
তোর মা আমার খেলার দোসর—যাকগে ও সব কথা,
এই দুপুরে বাঁশ কাটিয়া খাবি এখন কোথা?”

রূপাই বলে, “মা দিয়েছেন কোঁচায় বেঁধে চিঁড়া”
“ওমা! ও তুই বলিস কিরে? মুখখানা তোর ফিরা!
আমি হেথা থাকতে খালা, তুই থাকবি ভুখে,
শুনলে পরে তোর মা মোরে দুষবে কত রুখে!
ও সাজু, তুই বড় মোরগ ধরগে যেয়ে বাড়ি,
ওই গাঁ হতে আমি এদিক দুধ আনি এক হাঁড়ি |”

চলল সাজু বাড়ির দিকে, মা গেল ওই পাড়া |
বাঁশ কাটতে রূপাই এদিক মারল বাঁশে নাড়া |
বাঁশ কাটিতে রূপার বুকে ফেটে বেরোয় গান,
নলী বাঁশের বাঁশীতে কে মারছে যেন টান!
বেছে বেছে কাটল রূপাই ওড়া-বাঁশের গোড়া,
তল্লা বাঁশের কাটল আগা, কালধোয়ানির জোড়া ;
বাল্ কে কাটে আল্ কে কাটে কঞ্চি কাটে শত,
ওদিক বসে রূপার খালা রান্ধে মনের মত |

সাজু ডাকে তলা থেকে, “রূপা-ভাইগো এসো,”
—এই কথাটি বলতে তাহার লজ্জারো নাই শেষও!
লাজের ভারে হয়তো মেয়ে যেতেই পারে পড়ে,
রূপাই ভাবে হাত দুখানি হঠাৎ যেয়ে ধরে |

যাহোক রূপা বাঁশ কাটিয়া এল খালার বাড়ি,
বসতে তারে দিলেন খালা শীতল পাটি পাড়ি |
বদনা ভরে জল দিল আর খড়ম দিল মেলে,
পাও দুখানি ধুয়ে রূপাই বসল বামে হেলে |
খেতে খেতে রূপাই কেবল খালার তারীফ করে,
“অনেক দিনই এমন ছালুন খাইনি কারো ঘরে |”
খালায় বলে “আমি ত নয়, রেঁধেছে তোর বোনে,”
লাজে সাজুর ইচ্ছা করে লুকায় আঁচল কোণে |
এমনি নানা কথায় রূপার আহার হল সারা,
সন্ধ্যা বেলায় চলল ঘরে মাথায় বাঁশের ভারা |

খালার বাড়ির এত খাওয়া, তবুও তার মুখ,
দেখলে মনে হয় যে সেথা অনেক লেখা দুখ |
ঘরে যখন ফিরল রূপা লাগল তাহার মনে,
কি যেন তার হয়েছে আজ বাঁশ কাটিতে বনে |
মা বলিল, “বাছারে, কেন মলিন মুখে চাও?”
রূপাই কহে, “বাঁশ কাটিতে হারিয়ে এলেম দাও |”

নকশী কাঁথার মাঠ - ০৪

      জসীম উদ্দীন
চার

কানা দেয়ারে, তুই না আমার ভাই,
আরও ফুটিক ডলক দে, চিনার ভাত খাই
— মেঘরাজার গান

চৈত্র গেল ভীষণ খরায়, বোশেখ রোদে ফাটে,
এক ফোঁটা জল মেঘ চোঁয়ায়ে নামল না গাঁর বাটে |
ডোলের বেছন ডোলে চাষীর, বয় না গরু হালে,
লাঙল জোয়াল ধূলায় লুটায় মরচা ধরে ফালে |
কাঠ-ফাটা রোদ মাঠ বাটা বাট আগুন লয়ে খেলে,
বাউকুড়াণী উড়ছে তারি ঘূর্ণী ধূলী মেলে |
মাঠখানি আজ শূণ্য খাঁ খাঁ, পথ যেতে দম আঁটে,
জন্-মানবের নাইক সাড়া কোথাও মাঠের বাটে :
শুকনো চেলা কাঠের মত শুকনো মাঠের ঢেলা,
আগুন পেলেই জ্বলবে সেথায় জাহান্নামের খেলা |
দরগা তলা দুগ্ধে ভাসে, সিন্নি আসে ভারে :
নৈলা গানের ঝঙ্কারে গাঁও কানছে বারে বারে |
তবুও গাঁয়ে নামল না জল, গগনখানা ফাঁকা ;
নিঠুর নীলের বক্ষে আগুন করছে যেনে খাঁ খাঁ |

উচ্চে ডাকে বাজপক্ষি “আজরাইলে”র ডাক,
“খর দরজাল” আসছে বুঝি শিঙায় দিয়ে হাঁক!
এমন সময় ওই গাঁ হতে বদনা-বিয়ের গানে,
গুটি কয়েক আসলো মেয়ে এই না গাঁয়ের পানে |
আগে পিছে পাঁচটি মেয়ে—পাঁচটি রঙে ফুল,
মাঝের মেয়ে সোনার বরণ, নাই কোথা তার তুল |
মাথায় তাহার কুলোর উপর বদনা-ভরা জল,
তেল হলুদে কানায় কানায় করছে ছলাৎ ছল |
মেয়ের দলে বেড়িয়ে তারে চিকন সুরের গানে,
গাঁয়ের পথে যায় যে বলে বদনা-বিয়ের মানে |
ছেলের দলে পড়ল সাড়া, বউরা মিঠে হাসে,
বদনা বিয়ের গান শুনিতে সবাই ছুটে আসে |
পাঁচটি মেয়ের মাঝের মেয়ে লাজে যে যায় মরি,
বদনা হাতে ছলাৎ ছলাৎ জল যেতে চায় পড়ি |
এ-বাড়ি যায় ও-বাড়ি যায়, গানে মুখর গাঁ,
ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে যেন-রাম-শালিকের ছা |

কালো মেঘা নামো নামো, ফুল তোলা মেঘ নামো,
ধূলট মেঘা, তুলট মেঘা, তোমরা সবে ঘামো!
কানা মেঘা, টলমল বারো মেঘার ভাই,
আরও ফুটিক ডলক দিলে চিনার ভাত খাই!

কাজল মেঘা নামো নামো চোখের কাজল দিয়া,
তোমার ভালে টিপ আঁকিব মোদের হলে বিয়া!
আড়িয়া মেঘা, হাড়িয়া মেঘা, কুড়িয়া মেঘার নাতি,
নাকের নোলক বেচিয়া দিব তোমার মাথার ছাতি |
কৌটা ভরা সিঁদুর দিব, সিঁদুর মেঘের গায়,
আজকে যেন দেয়ার ডাকে মাঠ ডুবিয়া যায়!

দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো |
দেয়ারে তুমি নিষালে নিষালে নামো |
ঘরের লাঙল ঘরে রইল, হাইলা চাষা রইদি মইল ;
দেয়ারে তুমি অরিশাল বদনে ঢলিয়া পড় |
ঘরের গরু ঘরে রইল, ডোলের বেছন ডোলে রইল ;
দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো |

বারো মেঘের নামে নামে এমনি ডাকি ডাকি,
বাড়ি বাড়ি চলল তারা মাঙন হাঁকি হাঁকি
কেউবা দিল এক পোয়া চাল, কেউবা ছটাকখানি,
কেউ দিল নুন, কেউ দিল ডাল, কেউ বা দিল আনি |
এমনি ভাবে সবার ঘরে মাঙন করি সারা,
রূপাই মিয়ার রুশাই-ঘরের সামনে এল তারা |
রূপাই ছিল ঘর বাঁধিতে, পিছন ফিরে চায়,
পাঁটি মেয়ের রূপ বুঝি ওই একটি মেয়ের গায়!
পাঁচটি মেয়ে, গান যে গায়, গানের মতই লাগে,
একটি মেয়ের সুর ত নয় ও বাঁশী বাজায় আগে |
ওই মেয়েটির গঠন-গাঠন চলন-চালন ভালো,
পাঁচটি মেয়ের রূপ হয়েছে ওরই রূপে আলো |

রূপাইর মা দিলেন এনে সেরেক খানেক ধান,
রূপাই বলে, “এই দিলে মা থাকবে না আর মান |”
ঘর হতে সে এনে দিল সেরেক পাঁচেক চাল,
সেরেক খানেক দিল মেপে সোনা মুগের ডাল |
মাঙন সেরে মেয়ের দল চলল এখন বাড়ি,
মাঝের মেয়ের মাথার ঝোলা লাগছে যেন ভারি |
বোঝার ভারে চলতে নারে, পিছন ফিরে চায় ;
রূপার দুচোখ বিঁধিল গিয়ে সোনার চোখে হায়!

*****
ডলক = বৃষ্টি
বেছন = বীজ
বাউকুড়াণী = ঘূর্ণি বায়ু
জাহান্নাম = নরক
নৈলা গান = বৃষ্টি নামাবার জন্য চাষীরা এই গান গেয়ে থাকে
খর-দরজাল = প্রলয়ের দিনে ইনি বেহেস্ত ও দোযখ মাথায়
করে আসবেন | (খাড়া দর্জাল)
রুশাই-ঘরের = রান্না ঘরের