Sunday, 26 June 2016

মুক্তিযোদ্ধা









জসিম উদদীন


আমি একজন মুক্তি-যোদ্ধা, মৃত্যু পিছনে আগে,
ভয়াল বিশাল নখর মেলিয়া দিবস রজনী জাগী ।
কখনো সে ধরে রেজাকার বেশ, কখনো সে খান-সেনা,
কখনো সে ধরে ধর্ম লেবাস পশ্চিম হতে কেনা।
কখনো সে পশি ঢাকা-বেতারের সংরক্ষিত ঘরে,
ক্ষেপা কুকুরের মরণ-কামড় হানিছে ক্ষিপ্ত স্বরে।

আমি চলিয়াছি চির-নির্ভীক অবহেলি সবকিছু
নরমুণ্ডের ঢেলা ছড়াইয়া পশ্চাত-পথ পিছু।
ভাঙিতেছি স্কুল ভাঙিতেছি সেতু ষ্টিমার জাহাজ লরি,
খান-সৈন্যরা যেই পথে যায় আমি সে পথের অরি
ওরা ভাড়া-করা ঘৃণ্য গোলাম স্বার্থ-অন্ধ সব,
মিথ্যার কাছে বিকাতে এসেছে স্বদেশের বৈভব!

আমরা চলেছি রক্ষা করিতে মা-বোনের ইজ্জত,
শত শহীদের লোহুতে জ্বালানো আমাদের হিম্মত।
ভয়াল বিশাল আঁধার রাত্রে ঘন-অরণ্য ছায়,
লুণ্ঠিত আর দগ্ধ-গ্রামের অনল সম্মুখে ধায়।
তাহার আলোতে চলিয়াছি পথ, মৃত্যুর তরবার,
হস্তে ধরিয়া কাটিয়া চলেছি খান-সেনা অনিবার।

এ সোনার দেশে যতদিন রবে একটিও খান-সেনা,
ততদিন তব মোদের যাত্রা মুহুর্তে থামিবে না।
মাঠগুলি পুনঃ ফসলে ফসলে পরিবে রঙিন বেশ,
লক্ষ্মীর ঝাঁপি গড়ায়ে ছড়ায়ে ভরিবে সকল দেশ।
মায়ের ছেলেরা হবে নির্ভর, সুখ হাসি ভরা ঘরে,
দস্যুবিহীন এদেশ আবার শোভিবে সুষম ভরে।

আমাদের ছোট নদী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---সংকলিত (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।

চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।

আর-পারে আমবন তালবন চলে,
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।

সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।
বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।

আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।

সোনার তরী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---সোনার তরী
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
     কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
            রাশি রাশি ভারা ভারা
            ধান কাটা হল সারা,
            ভরা নদী ক্ষুরধারা
                    খরপরশা।
     কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
     একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
     চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
            পরপারে দেখি আঁকা
            তরুছায়ামসীমাখা
            গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
                    প্রভাতবেলা--
     এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
     গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
     দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
            ভরা-পালে চলে যায়,
            কোনো দিকে নাহি চায়,
            ঢেউগুলি নিরুপায়
                    ভাঙে দু-ধারে--
     দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে,
     বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
            যেয়ো যেথা যেতে চাও,
            যারে খুশি তারে দাও,
            শুধু তুমি নিয়ে যাও
                    ক্ষণিক হেসে
     আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
     যত চাও তত লও তরণী-'পরে।
     আর আছে?-- আর নাই, দিয়েছি ভরে।
            এতকাল নদীকূলে
            যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
            সকলি দিলাম তুলে
                    থরে বিথরে--
     এখন আমারে লহ করুণা করে।
     ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই-- ছোটো সে তরী
     আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
            শ্রাবণগগন ঘিরে
            ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
            শূন্য নদীর তীরে
                    রহিনু পড়ি--
     যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
  

Friday, 24 June 2016

পল্লীবর্ষা

জসীম উদ্‌দীন---ধান ক্ষেত

আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘের আড়ে,
কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।
কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জল-ধারা
তারি স্রোতে আজি শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া!
হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি,
নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে না জানি সে কোন দিঠি!
চিঠির উপরে চিঠি ভেসে যায় জনহীন বন বাটে,
না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া কার কেয়া-বন ঘাটে!
কোন্ সে বিরল বুনো ঝাউ শাখে বুনিয়া গোলাপী শাড়ী, -
হয়ত আজিও চেয়ে আছে পথে কানন-কুমার তারি!
দিকে দিগেনে- যতদূর চাহি, পাংশু মেঘের জাল
পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল।

গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়, -
গল্পের গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি,
কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধে কসি কসি।
কেউ তুলিতেছে বাঁশের লাঠিতে সুন্দর করে ফুল
কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কাঠ কেটে নির্ভুল।
মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীর সুরে,
আমীর সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।

লাঠির উপরে, ফুলের উপরে আঁকা হইতেছে ফুল,
কঠিন কাঠ সে সারিন্দা হয়ে বাজিতেছে নির্ভুল।
তারি সাথে সাথে গল্প চলেছে- আমীর সাধুর নাও,
বহুদেশ ঘুরে আজিকে আবার ফিরিয়াছে নিজ গাঁও।
ডাব্বা হুঁকাও চলিয়াছে ছুটি এর হতে ওর হাতে,
নানান রকম রসি বুনানও হইতেছে তার সাথে।
বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু গুরু মেঘ ডাকে,
এ সবের মাঝে রূপ-কথা যেন আর রূপকথা আঁকে!
যেন ও বৃদ্ধ, গাঁয়ের চাষীরা, আর ওই রূপ-কথা,
বাদলের সাথে মিশিয়া গড়িছে আরেক কল্প-লতা।

বউদের আজ কোনো কাজ নাই, বেড়ায় বাঁধিয়া রসি,
সমুদ্রকলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছে বসি।
কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,
তারে ভাষা দেয় দীঘল সূতার মায়াবী নকসা টানি।
বৈদেশী কোন্ বন্ধুর লাগি মন তার কেঁদে ফেরে,
মিঠে-সুরি-গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেঁড়ে।

আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে,
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।

নিমন্ত্রন

জসীম উদ্‌দীন---ধান ক্ষেত
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,

ছোট গাঁওখানি- ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া;
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী
পারের খবর টানাটানি করি;
বিনাসুতি মালা গাথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।

তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে, ছোট সে কাজল গাঁয়,
গলাগলি ধরি কলা বন; যেন ঘিরিয়া রয়েছে তায়।
সরু পথ খানি সুতায় বাঁধিয়া
দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া,
বনের হাওয়ায়, গাছের ছায়ায়, ধরিয়া রাখিবে তায়,
বুকখানি তার ভরে দেবে বুঝি, মায়া আর মমতায়!

তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে – নরম ঘাসের পাতে
চম্বন রাখি অধরখানিতে মেজে লয়ো নিরালাতে।
তেলাকুচা – লতা গলায় পরিয়া
মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,
হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,
তোমার গায়ের রংখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।

তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গে করি
নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী।
মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া
তোর সনে দেই মিতালী করিয়া
ঢেলা কুড়িইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি,
সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি।

তুমি যদি যাও – দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে,
সীম আর সীম – হাত বাড়াইলে মুঠি ভরে সেই খানে।
তুমি যদি যাও সে – সব কুড়ায়ে
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,
খাব আর যত গেঁঢো – চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,
হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব দুইজনে।

তুমি যদি যাও – শালুক কুড়ায়ে, খুব – খুব বড় করে,
এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে,
কারেও দেব না, তুমি যদি চাও
আচ্ছা না হয় দিয়ে দেব তাও,
মালাটিরে তুমি রাখিও কিন্তু শক্ত করিয়া ধরে,
ও পাড়াব সব দুষ্ট ছেলেরা নিতে পারে জোর করে;

সন্ধ্যা হইলে ঘরে ফিরে যাব, মা যদি বকিতে চায়,
মতলব কিছু আঁটির যাহাতে খুশী তারে করা যায়!
লাল আলোয়ানে ঘুঁটে কুড়াইয়া
বেঁধে নিয়ে যাব মাথায় করিয়া
এত ঘুষ পেয়ে যদি বা তাহার মন না উঠিতে চায়,
বলিব – কালিকে মটরের শাক এনে দেব বহু তায়।

খুব ভোর ক’রে উঠিতে হইবে, সূয্যি উঠারও আগে,
কারেও ক’বি না, দেখিস্ পায়ের শব্দে কেহ না জাগে
রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে
ডানকিনে মাছ কিলবিল করে;
কাদার বাঁধন গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগে ভাগে
সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে।

ভর দুপুরেতে এক রাশ কাঁদা আর এক রাশ মাছ,
কাপড়ে জড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ।
ওরে মুখ – পোড়া ওরে রে বাঁদর।
গালি – ভরা মার অমনি আদর,
কতদিন আমি শুনি নারে ভাই আমার মায়ের পাছ;
যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ।

যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।
ঘন কালো বন – মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।
গাছের ছায়ায় বনের লতায়
মোর শিশুকাল লুকায়েছে হায়!
আজি সে – সব সরায়ে সরায়ে খুজিয়া লইব তায়,
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গায়।

তোরে নিয়ে যাব আমাদের গাঁয়ে ঘন-পল্লব তলে
লুকায়ে থাকিস্, খুজে যেন কেহ পায় না কোনই বলে।
মেঠো কোন ফুল কুড়াইতে যেয়ে,
হারাইয়া যাস্ পথ নাহি পেয়ে;
অলস দেহটি মাটিতে বিছায়ে ঘুমাস সন্ধ্যা হলে,
সারা গাঁও আমি খুজিয়া ফিরিব তোরি নাম বলে বলে।

ধানক্ষেত

জসীম উদ্‌দীন---ধান ক্ষেত

পথের কেনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা সঙ্কেত,
সবুজে হদুদে সোহাগ ঢুলায়ে আমার ধানের ক্ষেত।
ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে,
ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়ে পাখিগুলে শুয়েছে মাঠের পরে।
কৃষাণ কনের বিয়ে হবে, তার হলদি কোটার শাড়ী,
হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কটি রোদ রেখা নাড়ি।
কলমী লতার গহনা তাহার গড়ার প্রতীক্ষায়,
ভিনদেশী বর আসা যাওয়া করে প্রভাত সাঁঝের নায়।

পথের কেনারে মোর ধান ক্ষেত, সবুজ পাতার পরে,
সোনার ছড়ায় হেমন্তরাণী সোনা হাসিখানি ধরে।
শরৎ সে কবে চরে গেছে তার সোনালী মেঘের ছটা,
আজো উড়িতেছে মোর এই খেতে ধরিয়া ধানের জটা।

মাঝে মাঝে এর পকিয়াছে ধান, কোনখানে পাকে নাই,
সকুজ শাড়ীর অঞ্চলে যেন ছোপ লাগিয়াছে তাই।
আজান গাঁয়ের কৃষাণকুমারী এইখান দিয়ে যেতে,
সোনার পায়ের চিহ্নগুলিরে গেছে এর বুকে পেতে।

মোর ধানক্ষেত, এইখানে এসে দাঁড়ালে উচচ শিরে,
মাথা যেন মোর ছুঁইবারে পারে সুদূর আকাশটিরে!
এইকানে এসে বুক ফুলাইয়া জোরে ডাক দিতে পারি,
হেথা আমি করি যা খুশী তাহাই, কারো নাহি ধার ধারি।
হেথায় নাহিক সমাজ-শাসন, নাহি প্রজা আর সাজা,
মোর ক্ষেত ভরি ফসলেরা নাচে, আমি তাহাদের রাজা।
এইখানে এসে দুঃখের কথা কহি তাহাদের সনে,
চৈত্র দিনের ভীষণ খরায় আষাঢ়ের বরিষণে।

কৃষাণী কনের কাঁকনের ঘায়ে ছিঁড়িয়া বুকের চাম,
এই ধানক্ষেত নয়নের জলে ভাসিয়েছি অবিরাম।
এইখানে বসে রাতের বেলায় বাঁশের বাঁশীর সুরে,
মোর ব্যথাখানি ছড়ায়েছি তার সুদূর কৃষাণ-পুরে।
এই ধানক্ষেত লুকাইয়া তার গোপন স্মৃতির চিন্,
দেখিয়া দেখিয়া কাটিয়া গিয়াছে কত না দীর্ঘদিন।

পথের কেনারে দাঁড়ায়ে রয়েছে আমার ধানের ক্ষেত,
আমার বুকের আশা-নিরাশার বেদনার সঙ্গেত।
বকের মেয়েরা গাঁথিয়া যতনে শ্বেত পালকের মালা,
চারিধারে এর ঘুরিয়া ঘুরিয়া সাজায় সোনার ডালা।
তাল বৃক্ষের উচু বাসা ছাড়ি বাবুই পাখির দল,
কিসের মায়ায় সারা ক্ষেত ভরি ফিরিতেছে চঞ্চল।
মাঝে মাঝে তারে জালে জড়াইয়া টেনে নিয়ে যেতে, চায়,
সকাল-সাঁঝের আলো-ছায়া-ঘেরা সোনালী তটের ছায়!
শিশির তাহারে মতির মালায় সাজায় সারাটি রাতি,
জোনাকীরা তার পাতায় পাতায় দোলায় তারার বাতি।

কুলি - মজুর

কাজী নজরুল ইসলাম---সর্বহারা

দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্‌?
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা।
তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!

আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!
সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে
এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!
তারি পদরজ অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি’,
সকলের সাথে পথে চলি’ যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি!
আজ নিখিলের বেদনা -আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!
আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্‌ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়-ক আমাদের এই ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়-ক ঝ’রে।
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,
উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান!

উমর ফারুক


উমর ফারুক
কাজী নজরুল ইসলাম



তিমির রাত্রি - 'এশা'র আযান শুনি দূর মসজিদে। 

প্রিয়-হারা কার কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়ে বিঁধে! 

                     আমির-উল-মুমেনিন, 
তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন। 
তকবির শুনি, শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি, 
বাতায়নে চাই-উঠিয়াছে কি-রে গগনে মরুর শশী? 
ও-আযান, ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান? 
মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহ্ববান? 

                     আবার লুটায়ে পড়ি। 
'সেদিন গিয়াছে' - শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি। 
উমর! ফারুক! আখেরি নবীর ওগো দক্ষিণ-বাহু! 
আহ্বান নয় - রূপ ধরে এস - গ্রাসে অন্ধতা-রাহু! 
ইসলাম-রবি, জ্যোতি তার আজ দিনে দিনে বিমলিন! 
সত্যের আলো  নিভিয়া-জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ। 
শুধু অঙ্গুলি-হেলনে শাসন করিতে এ জগতের 
দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের 
ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের ধরি 
আর একবার লোহিত-সাগরে লালে-লাল হয়ে মরি! 

ইসলাম - সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি? 
পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি। 
আজ বুঝি - কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর- 
'মোরপরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর।' 
*  *  *  *  *  *  *  *  *  * 
অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখতে বসি 
খেজুরপাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি 
সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক' নুয়ে, 
ঊর্ধ্বের যারা - পড়ছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভূঁয়ে। 
শত প্রলোভন বিলাস বাসনা ঐশ্বর্যের মদ 
করেছে সালাম দূর হতে সব ছুঁইতে পারেনি পদ। 
সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে, 
বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে। 

                     হেরি পশ্চাতে চাহি- 
তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি 
জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি 
বীর মুসলিম সেনাদল তব বহু দিন মাস ধরি। 
দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা বলেছে শত্রু শেষে- 
উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে! 
হায় রে, আধেক ধরার মালিক আমির-উল-মুমেনিন 
শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন 
সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু খানা শুকনো 'খবুজ' রুটি 
একটি  মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু তিন মুঠি। 
প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি 
চলেছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি! 
মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে, 
সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে। 
কিছুদূর যেতে উঠ হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, 'ভাই 
পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া! এইবার আমি যাই 
উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বস উটে, 
তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে।' 

                     ...ভৃত্য দস্ত চুমি 
কাঁদিয়া কহিল, 'উমর! কেমনে এ আদেশ কর তুমি? 
উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি 
আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি?' 

                     খলিফা হাসিয়া বলে, 
'তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে, এমনি ছলে। 
রোজ-কিয়ামতে আল্লাহ যে দিন কহিবে, 'উমর! ওরে 
করেনি খলিফা, মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে।' 
কি দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই। 
আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু, মোর অধিকার নাই। 
আরাম সুখের, -মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা। 
ইসলাম বলে, সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা। 

ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি, 
মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী। 
জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্প বৃষ্টি হইল কিনা, 
কি গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দী' বিশ্ববীণা। 
জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব- 
অনাগত কাল গেয়েছিল শুধু, 'জয় জয়  হে মানব।' 
*  *  *  *  *  *  *  *  *  * 
তুমি নির্ভীক, এক খোদা ছাড়া করনি ক' কারে ভয়, 
সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়। 
মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষেরি অপমান, 
তাই মহাবীর খালদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান, 
সিপাহ-সালারে ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা, 
বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না। 
*  *  *  *  *  *  *  *  *  * 
মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি, 
মনে পড়ে তব মহত্ত্ব-কথা - সেদিন সে বিভাবরী 
নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে 
মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুদাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে 

কাঁদিতেছে আর দুখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে হায়, 
উনানে শূন্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকুলে চায়। 
শুনিয়া সকল - কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে 
বায়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে, 
বলিলে, 'এসব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের 'পরে, 
আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে'। 
কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা, 
বলিলে, 'বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা! 
রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বল আমার পাপের ভার? 
মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজি তার 
প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি' - চলিলে নিশীথ রাতে 
পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে! 

                     এত যে কোমল প্রাণ, 
করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি ক' অপমান! 
মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে 
মেরেছ দোররা, মরেছে পুত্রে তোমার চোখের পরে! 
ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি- 
'অপরাধ করে তোরি মতো স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী।' 

                     আবু শাহমার গোরে 
কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে। 

খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে, 
'কোথায় খলিফা' কেবলি প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে, 
একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে, 
রৌদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে। 
হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট! 
অপমান তব করিব না আজ করিয়া  নান্দী পাঠ, 
মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই 
তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই। 

(সংক্ষেপিত)

সংকল্প

সংকল্প
কাজী নজরুল ইসলাম


থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,- 
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে। 
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে 
ছুটছে তারা কেমন করে, 
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে, 
কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণারে।। 

কেমন করে বীর ডুবুরী সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে, 
কেমন করে দুঃসাহসী চলছে উড়ে স্বরগ পানে। 
জাপটে ধরে ঢেউয়ের ঝুঁটি 
যুদ্ধ-জাহাজ চলছে ছুটি, 
কেমন করে আঞ্ছে মানিক বোঝাই করে সিন্ধু-যানে, 
কেমন জোরে টানলেসাগর উথলে ওঠে জোয়ার বানে। 

কেমন করে মথলে পাথার লক্ষী ওঠেন পাতাল ফুঁড়ে, 
কিসের অভিযানে মানুষ চলছে হিমালয় চুড়ে। 
তুহিন মেরু পার হয়ে যায় 
সন্ধানীরা কিসের আশায়; 
হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরেঃ 
শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোন 'মঙ্গল' হতে আসছে উড়ে।। 

কোন বেদনার টিকিট কেটে চন্ডু-খোর এ চীনের জাতি 
এমন করে উদয়-বেলায় মরণ-খেলায় ওঠল মাতি। 
আয়ার্ল্যান্ড আজ কেমন করে 
স্বাধীন হতে চলছে ওরেঃ 
তুরষ্ক ভাই কেমন করে কাঁটল শিকল রাতারাতি! 
কেমন করে মাঝ গগনে নিবল গ্রীসের সূর্য-বাতি।। 

রইব না কো বদ্ধ খাঁচায়, দেখব এ-সব ভুবন ঘুরে- 
আকাশ বাতাস চন্দ্র-তারায় সাগর-জলে পাহাড়-চুঁড়ে। 
আমার সীমার বাঁধন টুটে 
দশ দিকেতে পড়ব লুটেঃ 
পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়েঃ 
বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।।