Friday, 26 February 2016

স্বদেশী ভাষা - রামনিধি গুপ্ত



       নানান দেশে  নানান ভাষা  ।

    বিনে স্বদেশীয় ভাষা পুরে কি আশা ।।

     কত নদী সরোবর কিবা ফল চাতকীর

      ধারা জল বিনে কভু ঘুচে কি তৃষা ?


     ( উনবিংশ শতাব্দীর কবিওয়ালা ও বাংলা সাহিত্য ) 

Thursday, 25 February 2016

বঙ্গভাষা - মাইকেল মধুসূদন দত্ত




হে বঙ্গ,  ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;-

তা সবে,(অবোধ আমি!) অবহেলা করি,

পর- ধন - লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ

পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি !

অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায় মন:  ,

মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি  ;-

কেলিনু শৈবালে ; ভুলি কমল - কানন !

স্বপ্নে তব কুললক্ষী কয়ে দিলা পরে,  -

"ওরে বাছা মাতৃ - কোষে রতনের রাজি,

এ ভিখারী -  দশা তবে কেন তোর আজি?

যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে ! "

পালিলাম আজ্ঞা সুখে ; পাইলাম কালে

মাতৃভাষা - রূপে খনি,  পূর্ণ মণিজালে ।।

                  ( চতুর্দশপদী কবিতাবলী)


সেই দিন এই মাঠ - জীবনানন্দ দাশ



সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি -

এই নদী নক্ষত্রের তলে

সেদিনো দেখিবে স্বপ্ন -

সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!

আমি চলে যাব বলে

চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে

নরম গন্ধের ঢেউয়ে?

লক্ষী পেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষীটির তরে?

সোনার স্বপ্নের সাধপৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

চারিদিকে শান্ত বাতি- ভিজে গন্ধ- মৃদু কলরব;

খেয়া নৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে ;

পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;-

এশিরিয়া ধূলো আজ - বেবিলন ছাই হয়ে আছে । 

স্মৃতিস্তম্ভ




স্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার?ভয় কি বন্ধু,আমরা এখনো

                                                          চার কোটি পরিবার

খাড়া রয়েছি তো। যে ভিৎ কখো কোনো রাজন্য

                                 পারেনি ভাঙ্গতে

হারার মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার

খুরের ঝটিকা ধূলায় চূর্ণ  যে পদ প্রান্তে

                যারা বুনি ধান

গুণ টানি আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই

সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য ।

                      ইটের মিনার

ভেঙ্গেছে ভাঙ্গুক।  ভয় কি বন্ধু,দেখ একবার আমরা জাগরী

                                          চার কোটি পরিবার।।


এ কোন মৃত্যু?কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন ,

শিয়রে যার ওঠে না কান্না,  ঝরে না অশ্রু?

হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং

সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং।

এ কোন মৃত্যু? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,

বিরহে যেখানে নেই হাহাকার? কেবল সেতার

হয় প্রপাতের মোহনীয় ধারা, অনেক কথার

পদাতিক ঋতু কলমেরে দেয় কবিতার কাল?

ইটের মিনার ভেঙ্গেছে ভাঙ্গুক! একটি মিনার গড়েছি আমরা

                                          চার কোটি কারিগর ।

বেহালার সুরে, রাঙ্গা হ্রদয়ের বর্ণলেখায়।

                                    পলাশের আর

রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়

দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন,যুগে যুগে সেই

                            শহীদের নাম

এঁকেছি প্রেমের ফেনিল - শিলায়,তোমাদের নামে ।

                                    তাই আমাদের

হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক

                                            শপথের ভাস্বর ।।



                                 ( মানচিত্র) 

Tuesday, 23 February 2016

মানুষ

         কাজী নজরূল ইসলাম


                                           গাহি সাম্যের গান ----------

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান ।

নাই দেশ - কাল - পাত্রের ভেদ , অভেদ ধর্ম জাতি ,

সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি ।---

                      'পূজারী,  দুয়ার খোল,

ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হল !  '

স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়,

দেবতার বরে আজ রাজা - টাজা হয়ে যাবে নিশ্চয় !  ----

জীর্ণ -  বস্ত্র শীর্ণ - গাত্র,  ক্ষুধায় কণ্ঠ ক্ষীণ

ডাকিল পান্হ, 'দ্বার খোল বাবা, খাইনি ক সাত দিন। '

সহসা বন্ধ হল মন্দির,  ভুখারী ফিরিয়া চলে,

তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে।

                          ভুখারী ফুকারি'  কয় ,

ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয় !



মসজিদে কাল শিরনী আছিল,  অঢেল গোস্ত রূটি

বাঁচিয়া গিয়াছে,  মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি !

এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন্  ,

বল, 'বাবা, আমি ভুখা - ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন ! '

তেরিয়া হইয়া হাকিল মোল্লা -  " ভ্যালা হ'ল দেখি লেঠা,

ভুখা আছ মর গো -,, ভাগাড়ে গিয়ে !  নামাজ পড়িছ বেটা ? "

ভুখারী কহিল,  " না বাবা ! " মোল্লা হাকিল, ---"তা' হলে শালা,

সোজা পথ দেখ ! " গোস্ত - রূটি নিয়া মসজিদে দিল তালা !

                           ভুখারী ফিরিয়া চলে

                          চলিতে চলিতে বলে ------

"আশিটা বছর কেটে গেল,  আমি ডাকিনি তোমায় কভু ,

আমার ক্ষুধার অন্ন তা'বলে বন্ধ করোনি প্রভু !

তব মসজিদ -  মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,

মোল্লা - পুরূত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি  !  "

কোথায় চেঙ্গিস,  গজনী - মাহমুদ, কোথায় কালা পাহাড় ?

ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার!

খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়,  কে দেয় সেখানে তালা?

সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি- শাবল চালা !

                                  হায়রে ভজনালয় ,

তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয় !

                       মানুষেরে ঘৃণা করি'

ও কারা কোরান,  বেদ বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি '

ও মুখ হইতে কেতাব - গ্রন্হ নাও জোর করে কেড়ে,

যাহারা আনিল গ্রন্হ - কেতাব সেই মানুষেরে মেরে !

পূজিছে গ্রন্হ ভণ্ডের দল !   ----মূর্খরা সব শোনো,

মানুষ এনেছে গ্রন্হ ;----গ্রন্হ আনেনি মানুষ কোনো !

আদম,  দাউদ,  ঈসা, মূসা,ইব্রাহিম,  মোহাম্মদ

কৃষ্ন বুদ্ধ নানক কবির ---বিশ্বের সম্পদ,

আমাদেরি এরা পিতা পিতামহ,  এই আমাদের মাঝে

তাদেরই রক্ত কম বেশি করে প্রতি ধমনীতে রাজে ।

আমরা তাঁদেরই সন্তান,জ্ঞাতি, তাঁদেরই মতন দেহ

কে জানে কখন মোরা ও অমনি হয়ে যাতে পারি কেহ !

হেস না বন্ধু !  আমার আমি সে কত অতল অসীম,

আমিই কি জানি কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম !

হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি,  তোমাতে মেহেদি ঈসা,

কে জানে কাহার অন্ত ও আদি কে পায় কাহার দিশা  ?

কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই , কাহারে মারিছ লাথি ?

হয়ত উহারই বুকে ভগবান জাগিছেন দিবারাতি!

অথবা হয়ত কিছুই নহে সে,  মহান উচ্চ নহে ,

আছে ক্লেদাক্ত ,  ক্ষত - বিক্ষত পড়িয়া দুংখ - দহে ,

তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্হ ভজনালয়

ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়।

হয়ত ইহারই ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর - বাসে

জন্মিছে কেহ - জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে !

যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ , যে  মহাশক্তিধরে

আজিও বিশ্ব দেখেনি, হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে  ।


ও কে ?  চণ্ডাল ?  চমকাও কেন ?  নহে ও ঘৃণ্য জীব !

ওই হতে পারে হরিশ্চন্দ্র  , ওই শ্মশানের শিব ।

আজ চণ্ডাল কাল হতে পারে মহাযোগী - সম্রাট ,

তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী পাঠ ।

রাখাল বলিয়া কারে কর হেলা,   ও হেলা কাহারে বাজে !

হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে !

     ,                             চাষা বলে কর ঘৃণা !

দেখো চাষা রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলোকিনা ?

যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তাঁরাও ধরিল হাল,

তাঁরাই আনিল অমর বাণী- যা আছে রবে চিরকাল ।

দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিণী,

তারি মাঝে কবে এল ভোলা-নাথ গিরিজায়া , তা কি চিনি ?

তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্ঠি দিলে,

দ্বারী দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলে!

                                       সে মার রহিল জমা-

কে জানে তোমায় লাঞ্চিতা দেবী করিয়াছে কিনা ক্ষমা !

বন্ধু , তোমার বুক ভরা লোভ দু' চোখে স্বার্থ ঠুলি ,

নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হয়ছে কুলি ।

মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা,  বেদনা - মথিত সুধা,

তাই লুটে তুমি খাবে পশু ? তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা  !

তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে

তোমার মৃত্যু -বাণ আছেতব প্রাসাদের কোন খানে !

                                             তোমারই কামনা রাণী

যুগে যুগে ,  পশু , ফেলেছে  তোমায়  মৃত্যু  বিবরে  টানি  ।



            কবি : কাজী নজরূল ইসলাম

শেষ প্রার্থনা

আজ   চোখের জলে প্রর্থনা মোর শেষ বরষের শেষে,

যেন   এমনি কাটে আসছে জনম তোমায় ভালবেসে ।

             এমনি আদর, এমনি হেলা

              মান - অভিমান এমনি খেলা,

              এমনি ব্যথার বিদায় বেলা

                          এমনি চুমু হেসে,

যেন   খণ্ডমিলন পূর্ন করে নতুন জীবন এসে!

এবার    ব্যর্থ আমার আশা যেন সকল প্রেমে মেশে!


আজ চোখের জলে প্রার্থনা মোর শেষ বরষের শেষে !


যেন    আর না কাঁদায় দ্বন্দ্ব - বিরোধ,  হে মোর জীবন স্বামী !

এবার    এক হয়ে যাক প্রেমে তোমার তুমি আমার আমি !

              আপন সুখকে বড় ক'রে

              যে - দুখ পেলেম জীবন ভ'রে

              এবার তোমার চরণ ধ'রে

                     নয়ন জলে ভেসে

যেন     পূর্ণ ক'রে  তোমায় জিনে' সব হারানোর দেশে,

মোর    মরণ জয়ের বরণ - মালা পরাই তোমার কেশে।

আজ    চোখের জলে প্রার্থনা মোর শেষ বিদায়ের শেষে।।


                                                (দোলন - চাঁপা)



                 কবি  :  কাজী নজরূল ইসলাম

কি আনন্দ

একটি পাখি ডাকছে একা শরৎকালে

কি নাম যে তার কেমনে বলি?

এই সকালে

ঘুম ভাঙ্গা রোদ

ছড়িয়ে পড়ে হলুদ বরণ,

ডাক দিয়েছে হাক দিয়েছে জীবন মরণ।

পাখির পিছে ছুটতে গিয়ে কাঁপছি আমি

কাঁপছে ডানা নেই ঠিকানা

কোন দিকে যাই

একটু দাঁড়াই

হাত বাড়ালে ধরতে কি পাই

আঁচল তোমার !

ফুলের গন্ধে প্রাণ মাতানো - গানের কলি

উপচে উঠে কি আনন্দ,  কেমনে বলি ?


------- কবি : আল মাহমুদ

ইচ্ছাশক্তি




বিবেক দিয়েছ তুমি প্রত্যেকের করে

ইচ্ছার স্বাধীনতা অর্পণ করেছ

হে রাজাধিরাজ, প্রত্যেকের পরে ।

উদারতা যেথা ক্ষীণ দূর্বলতা

মনন বিকাশ চাই সেথাই সেথা ।

কল্যাণ করিবার ব্রত রসনায় মম

জ্বলি উঠি যেন তোমার ইঙ্গিতে ।

অন্যের ক্ষতি দেখিলে যেন

গর্জে উঠি  পরতে পরতে ।

পেশি শক্তি যেন নাহি ডরি

তোমারই আদেশ যেন শিরোধার্য করি।

দিয়েছ বিবেক, পেয়েছি স্বাধীন ইচ্ছা

মম কর্ম হয় গো যেন সাচ্চাই সাচ্চা ।



             রচয়িতা  : ডা.  মুহাম্মদ হেলাল উদ্দিন