Tuesday, 23 February 2016

মানুষ

         কাজী নজরূল ইসলাম


                                           গাহি সাম্যের গান ----------

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান ।

নাই দেশ - কাল - পাত্রের ভেদ , অভেদ ধর্ম জাতি ,

সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি ।---

                      'পূজারী,  দুয়ার খোল,

ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হল !  '

স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়,

দেবতার বরে আজ রাজা - টাজা হয়ে যাবে নিশ্চয় !  ----

জীর্ণ -  বস্ত্র শীর্ণ - গাত্র,  ক্ষুধায় কণ্ঠ ক্ষীণ

ডাকিল পান্হ, 'দ্বার খোল বাবা, খাইনি ক সাত দিন। '

সহসা বন্ধ হল মন্দির,  ভুখারী ফিরিয়া চলে,

তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে।

                          ভুখারী ফুকারি'  কয় ,

ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয় !



মসজিদে কাল শিরনী আছিল,  অঢেল গোস্ত রূটি

বাঁচিয়া গিয়াছে,  মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি !

এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন্  ,

বল, 'বাবা, আমি ভুখা - ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন ! '

তেরিয়া হইয়া হাকিল মোল্লা -  " ভ্যালা হ'ল দেখি লেঠা,

ভুখা আছ মর গো -,, ভাগাড়ে গিয়ে !  নামাজ পড়িছ বেটা ? "

ভুখারী কহিল,  " না বাবা ! " মোল্লা হাকিল, ---"তা' হলে শালা,

সোজা পথ দেখ ! " গোস্ত - রূটি নিয়া মসজিদে দিল তালা !

                           ভুখারী ফিরিয়া চলে

                          চলিতে চলিতে বলে ------

"আশিটা বছর কেটে গেল,  আমি ডাকিনি তোমায় কভু ,

আমার ক্ষুধার অন্ন তা'বলে বন্ধ করোনি প্রভু !

তব মসজিদ -  মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,

মোল্লা - পুরূত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি  !  "

কোথায় চেঙ্গিস,  গজনী - মাহমুদ, কোথায় কালা পাহাড় ?

ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার!

খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়,  কে দেয় সেখানে তালা?

সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি- শাবল চালা !

                                  হায়রে ভজনালয় ,

তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয় !

                       মানুষেরে ঘৃণা করি'

ও কারা কোরান,  বেদ বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি '

ও মুখ হইতে কেতাব - গ্রন্হ নাও জোর করে কেড়ে,

যাহারা আনিল গ্রন্হ - কেতাব সেই মানুষেরে মেরে !

পূজিছে গ্রন্হ ভণ্ডের দল !   ----মূর্খরা সব শোনো,

মানুষ এনেছে গ্রন্হ ;----গ্রন্হ আনেনি মানুষ কোনো !

আদম,  দাউদ,  ঈসা, মূসা,ইব্রাহিম,  মোহাম্মদ

কৃষ্ন বুদ্ধ নানক কবির ---বিশ্বের সম্পদ,

আমাদেরি এরা পিতা পিতামহ,  এই আমাদের মাঝে

তাদেরই রক্ত কম বেশি করে প্রতি ধমনীতে রাজে ।

আমরা তাঁদেরই সন্তান,জ্ঞাতি, তাঁদেরই মতন দেহ

কে জানে কখন মোরা ও অমনি হয়ে যাতে পারি কেহ !

হেস না বন্ধু !  আমার আমি সে কত অতল অসীম,

আমিই কি জানি কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম !

হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি,  তোমাতে মেহেদি ঈসা,

কে জানে কাহার অন্ত ও আদি কে পায় কাহার দিশা  ?

কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই , কাহারে মারিছ লাথি ?

হয়ত উহারই বুকে ভগবান জাগিছেন দিবারাতি!

অথবা হয়ত কিছুই নহে সে,  মহান উচ্চ নহে ,

আছে ক্লেদাক্ত ,  ক্ষত - বিক্ষত পড়িয়া দুংখ - দহে ,

তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্হ ভজনালয়

ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়।

হয়ত ইহারই ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর - বাসে

জন্মিছে কেহ - জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে !

যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ , যে  মহাশক্তিধরে

আজিও বিশ্ব দেখেনি, হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে  ।


ও কে ?  চণ্ডাল ?  চমকাও কেন ?  নহে ও ঘৃণ্য জীব !

ওই হতে পারে হরিশ্চন্দ্র  , ওই শ্মশানের শিব ।

আজ চণ্ডাল কাল হতে পারে মহাযোগী - সম্রাট ,

তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী পাঠ ।

রাখাল বলিয়া কারে কর হেলা,   ও হেলা কাহারে বাজে !

হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে !

     ,                             চাষা বলে কর ঘৃণা !

দেখো চাষা রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলোকিনা ?

যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তাঁরাও ধরিল হাল,

তাঁরাই আনিল অমর বাণী- যা আছে রবে চিরকাল ।

দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিণী,

তারি মাঝে কবে এল ভোলা-নাথ গিরিজায়া , তা কি চিনি ?

তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্ঠি দিলে,

দ্বারী দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলে!

                                       সে মার রহিল জমা-

কে জানে তোমায় লাঞ্চিতা দেবী করিয়াছে কিনা ক্ষমা !

বন্ধু , তোমার বুক ভরা লোভ দু' চোখে স্বার্থ ঠুলি ,

নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হয়ছে কুলি ।

মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা,  বেদনা - মথিত সুধা,

তাই লুটে তুমি খাবে পশু ? তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা  !

তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে

তোমার মৃত্যু -বাণ আছেতব প্রাসাদের কোন খানে !

                                             তোমারই কামনা রাণী

যুগে যুগে ,  পশু , ফেলেছে  তোমায়  মৃত্যু  বিবরে  টানি  ।



            কবি : কাজী নজরূল ইসলাম

No comments:

Post a Comment