Friday, 20 October 2017

নক্সী কাঁথার মাঠ - দশ

নক্সী কাঁথার মাঠ - দশ


নতুন চাষা ও নতুন চাষাণী পাতিল নতুন ঘর, বাবুই পাখিরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর | মাঠের কাজেতে ব্যস্ত রূপাই, নয়া বউ গেহ কাজে, দুইখান হতে দুটি সুর যেন এ উহারে ডেকে বাজে | ঘর চেয়ে থাকে কেন মাঠ পানে, মাঠ কেন ঘর পানে, দুইখানে রহি দুইজন আজি বুঝিছে ইহার মানে | আশ্বিন গেল, কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান, সারা মাঠ ভরি গাহিতেছে কে যেন হল্ দি-কোটার গান | ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়, কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায় | আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে, মাঝে মাঠখানি চাদর বিছায়ে হলুদ বরণ ধানে | আজকে রূপার বড় কাজ---কাজ---কোন অবসর নাই, মাঠে যেই ধান ধরেনাক আজি ঘরে দেবে তারে ঠাঁই | সারা মাঠে ধান, পথে ঘাটে ধান উঠানেতে ছড়াছড়ি, সারা গাঁও ভরি চলেছে কে কবি ধানের কাব্য পড়ি | আজকে রূপার মনে পড়েনাক শাপলার লতা দিয়ে, নয়া গৃহিনীর খোঁপা বেঁধে দিত চুলগুলি তার নিয়ে | সিঁদুর লইয়া মান হয়নাক বাজে না বাঁশের বাঁশী, শুধু কাজ---কাজ, কি যাদু-মন্ত্র ধানেরা পড়িছে আসি | সারাটি বরষা কে কবি বসিয়া বেঁধেছে ধানের গান, কত সুদীর্ঘ দিবস রজনী করিয়া সে অবসান | আজকে তাহার মাঠের কাব্য হইয়াছে বুঝি সারা, ছুটে গেঁয়ো পাখি ফিঙে বুলবুল তারি গানে হয়ে হারা | কৃষাণীর গায়ে গহনা পরায় নতুন ধানের কুটো ; এত কাজ তবু হাসি ধরেনাক, মুখে ফুল ফুটো ফুটো! আজকে তাহার পাড়া-বেড়ানর অবসর মোটে নাই, পার খাড়ুগাছি কোথা পড়ে আছে, কেবা খোঁজ রাখে ছাই! অর্ধেক রাত উঠোনেতে হয় ধানের মলন মলা, বনের পশুরা মানুষের কাজে মিশায় গলায় গলা | দাবায় শুইয়া কৃষাণ ঘুমায়, কৃষাণীর কাজ ভারি, ঢেকির পারেতে মুখর করিছে একেলা সারাটি বাড়ি | কোন দিন চাষী শুইয়া শুইয়া গাহে বিরহের গান, কৃষাণের নারী ঘুমাইয়া পড়ে, ঝাড়িতে ঝাড়িতে ধান | হেমন্ত চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোত্স্নার জাল পাতি, টেনে টেনে তারে হয়রান হয়ে ডুবে যায় রাতারাতি | এমনি করিয়া ধানের কাব্য হইয়া আসিল সারা, গানের কাব্য আরম্ভ হল সারাটা কৃষাণ পাড়া! রাতেরে উহারা মানিবে না যেন, নতুন গলার গানে, বাঁশী বাজাইয়া আজকে রাতের করিবে নতুন মানে | আজিকে রূপার কোন কাজ নাই, ঘুম হতে যেন জাগি, শিয়রে দেখিছে রাজার কুমারী তাহারই ব্যথার ভাগী | সাজুও দেখিছে কোথাকার যেন রাজার কুমার আজি, ঘুম হতে তারে সবে জাগায়েছে অরুণ-আলোয় সাজি | নতুন করিয়া আজকে উহারা চাহিছে এ ওর পানে, দীর্ঘ কাজের অবসর যেন কহিছে নতুন মানে! নতুন চাষার নতুন চাষাণী নতুন বেঁধেছে ঘর, সোহাগে আদরে দুটি প্রাণ যেন করিতেছে নড়নড়! বাঁশের বাঁশীতে ঘুণ ধরেছিল, এতদিন পরে আজ, তেলে জলে আর আদরে তাহার হইল নতুন সাজ | সন্ধ্যার পরে দাবায় বসিয়া রূপাই বাজায় বাঁশী, মহাশূণ্যের পথে সে ভাসায় শূণ্যের সুররাশি! ক্রমে রাত বাড়ে, বউ বসে দূরে, দুটি চোখ ঘুমে ভার, "পায়ে পড়ি ওগো চলো শুতে যাই, ভাল লাগে নাক আর |" রূপা ত সে কথা শোনেই নি যেন, বাঁশী বাজে সুরে সুরে, "ঘরে দেখে যারে সেই যেন আজি ফেরে ওই দূরে দূরে |" বউ রাগ করে, "দেখ, বলে রাখি, ভাল হবেনাক পরে, কালকের মত কর যদি তবে দেখিও মজাটি করে | ওমনি করিয়া সারারাত আজি বাজাইবে যদি বাঁশী, সিঁদুর আজিকে পরিব না ভালে, কাজল হইবে বাসি | দেখ, কথা শোন, নইলে এখনি খুলিব কানের দুল, আজকে ত আমি খোঁপা বাঁধিব না, আলগা রহিবে চুল |" বেচারী রূপাই বাঁশী বাজাইতে এমনি অত্যাচার, কৃষাণের ছেলে! অত কিবা বোঝে, তখনই মানিল হার | কহে জোড় করে, "শোন গো হুজুর, অধম বাঁশীর প্রতি, মৌন থাকার কঠোর দণ্ড অন্যায় এ যে অতি | আজকে ও-ভালে সিঁদুর দিবে না, খুলিবে কানের দুল, সন্ধ্যে হবে না সিঁদুরে রঙের---ভোরে হাসিবে না ফুল! এক বড় কথা! আচ্ছা দেখাই, ওরে ও অধম বাঁশী, এই তরুণীর অধরের গানে তোমার হইবে ফাঁসী!" হাতে লয়ে বাঁশী বাজাইল রূপা মাঠের চিকন সুরে, কভু দোলাইয়া বউটির ঠোঁটে কভু তারে ঘুরে ঘুরে | বউটি যেন গো হেসে হয়রান, কহে ঠোঁটে ঠোঁট চাপি, "বাঁশীর দণ্ড হইল, কিন্তু যে বাজাল সে পাপী?" পুনঃ জোর করে রূপা কহে, "এই অধমের অপরাধ, ভয়ানক যদি, দণ্ড তাহার কিছু কম নিতে সাধ!" রূপার বলার এমনি ভঙ্গী বউ হেসে কুটি কুটি, কখনও পড়িছে মাটিতে ঢলিয়া, কভু গায়ে পড়ে লুটি | পরে কহে, "দেখো, আরও কাছে এসো, বাঁশীটি লও তো হাতে, এমনি করিয়া দোলাও ত দেখি নোলক দোলার সাথে!" বাঁশী বাজে আর নোলক যে দোলে, বউ কহে আর বার, "আচ্ছা আমার বাহুটি নাকিগো সোনালী লতার হার? এই ঘুরালেম, বাজাও ত দেখি এরি মত কোন সুর," তেমনি বাহুর পরশের মত বাজে বাঁশী সুমধুর! দুটি করে রাঙা ঠোঁটখানি টেনে কহে বউ, "এরি মত, তোমার বাঁশীতে সুর যদি থাকে বাজাইলে বেশ হত |" চলে মেঠো বাঁশী দুটি ঠোঁট ছুঁয়ে কলমী ফুলের বুকে, ছোট চুমু রাখি চলে যেন বাঁশী, চলে সে যে কোন লোকে | এমনি করিয়া রাত কেটে যায় ; হাসে রবি ধীরি ধীরি, বেড়ার ফাঁকেতে উঁকি মেরে দেখি দুটি খেয়ালীর ছিরি | সেদিন রাত্রে বাঁশী শুনে শুনে বউটি ঘুমায়ে পড়ে, তারি রাঙা মুখে বাঁশী-সুরে রূপা বাঁকা চাঁদ এনে ধরে | তারপরে খুলে চুলের বেণীটি বার বার করে দেখে, বাহুখানি দেখে নাড়িয়া নাড়িয়া বুকের কাছেতে রেখে | কুসুম-ফুলেতে রাঙা পাও দুটি দেখে আরো রাঙা করি, মৃদু তালে তালে নিঃশ্বাস লয়, শুনে মুখে মুখ ধরি | ভাবে রূপা, ও-যে দেহ ভরি যেন এনেছে ভোরের ফুল, রোদ উঠিলেই শুকাইয়া যাবে, শুধু নিমিষের ভুল! হায় রূপা, তুই চোখের কাজলে আঁকিলি মোহন ছবি, এতটুকু ব্যথা না লাগিতে যেরে ধুয়ে যাবে তোর সবি! ওই বাহু আর ওই তনু-লতা ভাসিছে সোঁতের ফুল, সোঁতে সোঁতে ও যে ভাসিয়া যাইবে ভাঙিয়া রূপার কূল! বাঁশী লয়ে রূপা বাজাতে বসিল বড় ব্যথা তার মনে, উদাসীয়া সুর মাথা কুটে মরে তাহার ব্যথার সনে | ধারায় ধারায় জল ছুটে যায় রূপার দুচোখ বেয়ে, বইটি তখন জাগিয়া উঠিল তাহার পরশ পেয়ে | "ওমা ওকি? তুমি এখনো শোওনি! খোলা কেন মোর চুল? একি! দুই পায়ে কে দেছে ঘষিয়া রঙিন কুসুম ফুল? ওকি! ওকি!! তুমি কাঁদছিলে বুঝি! কেন কাঁদছিলে বল?" বলিতে বলিতে বউটির চোখ জলে করে ছল ছল! বাহুখানা তার কাঁধ পরে রাখি রূপা কয় মৃদু সুরে, "শোন শোন সই, কে যেন তোমায় নিয়ে যেতে চায় দূরে!" "সে দূর কোথায়?" "অনেক---অনেক---দেশ যেতে হয় ছেড়ে, সেথা কেউ নাই শুধু আমি তুমি আর সেই সে অচেনা ফেরে | তুমি ঘুমাইলে সে এসে আমায় কয়ে যায় কানে কানে, যাই---যাই---ওরে নিয়ে যাই আমি আমার দেশের পানে | বল, তুমি সেথা কখনও যাবে না, সত্যি করিয়া বল!" "নয়! নয়! নয়!" বউ কহে তার চোখ দুটি ছল ছল | রূপা কয় "শোন সোনার বরণি, আমার এ কুঁড়ে ঘর, তোমার রূপের উপহাস শুধু করে সারা দিনভর | তুমি ফুল! তব ফুলের গায়েতে বহে বিহানের বায়ু, আমি কাঁদি সই রোদ উঠিলে যে ফুরাবে রঙের আয়ু | আহা আহা সখি, তুমি যাহা কর, মোর মনে লয় তাই, তোমার ফুলের পরাণে কেবল দিয়া যায় বেদনাই |" এমন সময় বাহির হইতে বছির মামুর ডাকে, ধড়মড় করি উঠিয়া রূপাই চাহিল বেড়ার ফাঁকে |

Wednesday, 18 October 2017

তালগাছ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।
মনে সাধ,কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়,
একেবারে উড়ে যায়
কোথা পাবে পাখা সে ।
তাই তো সে ঠিক তার মাথাতে
গোল গোল পাতাতে
ইচ্ছাটি মেলে তার
মনে মনে ভাবে বুঝি ডানা এই,
উড়ে যেতে মানা নেই
বাসাখানি ফেলে তার ।
সারাদিন ঝরঝর থত্থর
কাঁপে পাতা পত্তর
ওড়ে যেন ভাবে ও,
মনে মনে আকাশেতে বেড়িয়ে
তারাদের এড়িয়ে
যেন কোথা যাবে ও।

Saturday, 30 September 2017

দুই বিঘা জমি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।
কহিলাম আমি, তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই।
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই।
শুনি রাজা কহে, বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থ ও দিঘে সমান হইবে টানা-
ওটা দিতে হবে। কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, আচ্ছা, সে দেখা যাবে।
(৭৯)
পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে-
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি –
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য
কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য!
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এই মতো কাটে বছর পনেরো-ষোল –
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হলো।
নমঃনমঃনমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ,
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল-নিশীথশীতল স্নেহ।
বুকভরা মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে-
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে-
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি রথতলা করি বামে,
রাখি হাটখোলা, নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।
ধিক ধিক ওরে, শত ধিক তোরে, নিলাজ কুলটা ভূমি!
যখনি যাহার তখনি তাহার, এই কী জননী তুমি!
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফল ফুল শাক পাতা!
আজ কোন রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ-
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন-
(৮০)
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন।
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন!
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি, ক্ষুধাহরা সুধারাশি!
যত হাসো আজ যত করো সাজ ছিলে দেবী, হলে দাসী।
বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি-
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে, সেই আমগাছ, এ কি!
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালক-কালের কথা।
সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা পলায়ন-
ভাবিলাম হায় আর কী কোথায় ফিরে পাব সে জীবন!
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা,
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।
হেনকালে হায় যমদূত প্রায় কোথা হতে এল মালী,
ঝুঁটি-বাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব-
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব!
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ সাথে ধরিতে ছিলেন মাছ।
শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, মারিয়া করিব খুন।
বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ।
আমি কহিলাম, শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!
বাবু কহে হেসে বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়।
আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে-
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!

Friday, 29 September 2017

নদী স্বপ্ন

nodirsapno
চিত্র: নদীর স্বপ্ন
কোথায় চলেছো ? এদিকে এসো না!
দুটো কথা শোনো দিকি,
এই নাও-এই চকচকে, ছোটো,
নতুন রুপোর সিকি।
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে,
তোমায় দিচ্ছি তাও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে
নৌকায় তুলে নাও।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে-
যাবে কি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো
মোরে আর ছোকানুরে।
আমারে চেনো না? আমি যে কানাই।
ছোকানু আমার বোন।
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা
মেঘনা, পদ্মা, শোণ।
শোনো, মা এখন ঘুমিয়ে আছেন
দিদি গেছে ইশকুলে,
এই ফাঁকে মোরে-আর ছোকানুরে-
নৌকোয় নাও তুলে।
কোনো ভয় নেই-বাবার বকুনি
তোমায় হবে না খেতে,
যত দোষ সব আমরা-না, আমি
একা নেবো মাথা পেতে।
অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি?
বেগুনি, বাদামি, লাল?
হলদেও?-তবে সেটা দাও আজ,
বেগুনিটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু!
আগে পদ্মায় চলো,
দুপুরের রোদে ঝলমলে জল
বয়ে যায় ছলোছলো।
শুয়ে-শুয়ে দেখি অবাক আকাশ,
আকাশ ম-স্ত বড়ো,
পৃথিবীর সব নীল রং বুঝি
সেখানে করেছে জড়ো।
ঝাঁকে ঝাঁকে বেঁকে ঐ দ্যাখো পাখি
উড়ে চলে যায় দূরে
উঁচু থেকে ওরা দেখতে কী পায়
মোরে আর ছোকানুরে?
ওটা কী? জেলের নৌকা? তাই তো!
জাল টেনে তোলা দায়,
(১০২)
রূপোলি নদীর রূপোলি ইলিশ-
ইশ, চোখে ঝলসায়!
ইলিশ কিনলে? -আঃ, বেশ, বেশ,
তুমি খুব ভালো, মাঝি।
উনুন ধরাও, ছোকানু দেখাক
রান্নার কারসাজি।
পইঠায় বসে ধোঁয়া-ওঠা ভাত,
টাটকা ইলিশ-ভাজা-
ছোকানু রে, তুই আকাশের রানী,
আমি পদ্মার রাজা।
খাওয়া হলো শেষ, আবার চলছি
দুলছে ছোট্ট নাও,
হালকা নরম হাওয়ায় তোমার
লাল পাল তুলে দাও।
দেখি বসে বসে আকাশের রং
কী আশ্চর্য নীল
ছোটো পাখি আরও ছোটো হয়ে যায়
আকাশের মুখে তিল।
সারাদিন গেলো, সূর্য লুকোলো
জলের তলার ঘরে
সোনা হয়ে জ্বলে পদ্মার জল
কালো হলো তার পরে।
সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে-
এবার নামাও পাল,
গান ধরো, মাঝি; জলের শব্দ
ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে
আমি ঠিক জেগে আছি
গান গাওয়া হলে আমায় অনেক
গল্প বলবে, মাঝি?
শুনতে শুনতে আমি ঘুমোই
বিছানা বালিশ বিনা-
মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই,
ও বড়োই ভীতু কিনা।
আমার জন্যে কিচ্ছু ভেবো না
আমি তো বড়োই প্রায়
ঝড় এলে ডেকো আমারে-ছোকানু
যেন সুখে ঘুম যায়।
সব নাও, মাঝি, চকচকে সিকি
এই আনি দুটো, তাও।
লক্ষ্মী তো, মোরে-আর ছোকানুরে
নৌকায় তুলে নাও।

চাষা/ কৃষাণ

সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, 
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা। 
দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিল বড়? 
পুণ্য অত হবে নাক সব করিলে জড়। 
মুক্তিকামী মহাসাধক মুক্ত করে দেশ, 
সবারই সে অন্ন জোগায় নাইক গর্ব লেশ। 
ব্রত তাহার পরের হিত, সুখ নাহি চায় নিজে, 
রৌদ্র দাহে শুকায় তনু, মেঘের জলে ভিজে। 
আমার দেশের মাটির ছেলে, নমি বারংবার 
তোমায় দেখে চূর্ণ হউক সবার অহংকার।