Saturday, 30 September 2017

দুই বিঘা জমি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।
কহিলাম আমি, তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই।
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই।
শুনি রাজা কহে, বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থ ও দিঘে সমান হইবে টানা-
ওটা দিতে হবে। কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, আচ্ছা, সে দেখা যাবে।
(৭৯)
পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে-
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি –
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য
কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য!
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এই মতো কাটে বছর পনেরো-ষোল –
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হলো।
নমঃনমঃনমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ,
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল-নিশীথশীতল স্নেহ।
বুকভরা মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে-
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে-
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি রথতলা করি বামে,
রাখি হাটখোলা, নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।
ধিক ধিক ওরে, শত ধিক তোরে, নিলাজ কুলটা ভূমি!
যখনি যাহার তখনি তাহার, এই কী জননী তুমি!
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফল ফুল শাক পাতা!
আজ কোন রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ-
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন-
(৮০)
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন।
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন!
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি, ক্ষুধাহরা সুধারাশি!
যত হাসো আজ যত করো সাজ ছিলে দেবী, হলে দাসী।
বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি-
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে, সেই আমগাছ, এ কি!
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালক-কালের কথা।
সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা পলায়ন-
ভাবিলাম হায় আর কী কোথায় ফিরে পাব সে জীবন!
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা,
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।
হেনকালে হায় যমদূত প্রায় কোথা হতে এল মালী,
ঝুঁটি-বাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব-
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব!
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ সাথে ধরিতে ছিলেন মাছ।
শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, মারিয়া করিব খুন।
বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ।
আমি কহিলাম, শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!
বাবু কহে হেসে বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়।
আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে-
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!

Friday, 29 September 2017

নদী স্বপ্ন

nodirsapno
চিত্র: নদীর স্বপ্ন
কোথায় চলেছো ? এদিকে এসো না!
দুটো কথা শোনো দিকি,
এই নাও-এই চকচকে, ছোটো,
নতুন রুপোর সিকি।
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে,
তোমায় দিচ্ছি তাও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে
নৌকায় তুলে নাও।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে-
যাবে কি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো
মোরে আর ছোকানুরে।
আমারে চেনো না? আমি যে কানাই।
ছোকানু আমার বোন।
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা
মেঘনা, পদ্মা, শোণ।
শোনো, মা এখন ঘুমিয়ে আছেন
দিদি গেছে ইশকুলে,
এই ফাঁকে মোরে-আর ছোকানুরে-
নৌকোয় নাও তুলে।
কোনো ভয় নেই-বাবার বকুনি
তোমায় হবে না খেতে,
যত দোষ সব আমরা-না, আমি
একা নেবো মাথা পেতে।
অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি?
বেগুনি, বাদামি, লাল?
হলদেও?-তবে সেটা দাও আজ,
বেগুনিটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু!
আগে পদ্মায় চলো,
দুপুরের রোদে ঝলমলে জল
বয়ে যায় ছলোছলো।
শুয়ে-শুয়ে দেখি অবাক আকাশ,
আকাশ ম-স্ত বড়ো,
পৃথিবীর সব নীল রং বুঝি
সেখানে করেছে জড়ো।
ঝাঁকে ঝাঁকে বেঁকে ঐ দ্যাখো পাখি
উড়ে চলে যায় দূরে
উঁচু থেকে ওরা দেখতে কী পায়
মোরে আর ছোকানুরে?
ওটা কী? জেলের নৌকা? তাই তো!
জাল টেনে তোলা দায়,
(১০২)
রূপোলি নদীর রূপোলি ইলিশ-
ইশ, চোখে ঝলসায়!
ইলিশ কিনলে? -আঃ, বেশ, বেশ,
তুমি খুব ভালো, মাঝি।
উনুন ধরাও, ছোকানু দেখাক
রান্নার কারসাজি।
পইঠায় বসে ধোঁয়া-ওঠা ভাত,
টাটকা ইলিশ-ভাজা-
ছোকানু রে, তুই আকাশের রানী,
আমি পদ্মার রাজা।
খাওয়া হলো শেষ, আবার চলছি
দুলছে ছোট্ট নাও,
হালকা নরম হাওয়ায় তোমার
লাল পাল তুলে দাও।
দেখি বসে বসে আকাশের রং
কী আশ্চর্য নীল
ছোটো পাখি আরও ছোটো হয়ে যায়
আকাশের মুখে তিল।
সারাদিন গেলো, সূর্য লুকোলো
জলের তলার ঘরে
সোনা হয়ে জ্বলে পদ্মার জল
কালো হলো তার পরে।
সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে-
এবার নামাও পাল,
গান ধরো, মাঝি; জলের শব্দ
ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে
আমি ঠিক জেগে আছি
গান গাওয়া হলে আমায় অনেক
গল্প বলবে, মাঝি?
শুনতে শুনতে আমি ঘুমোই
বিছানা বালিশ বিনা-
মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই,
ও বড়োই ভীতু কিনা।
আমার জন্যে কিচ্ছু ভেবো না
আমি তো বড়োই প্রায়
ঝড় এলে ডেকো আমারে-ছোকানু
যেন সুখে ঘুম যায়।
সব নাও, মাঝি, চকচকে সিকি
এই আনি দুটো, তাও।
লক্ষ্মী তো, মোরে-আর ছোকানুরে
নৌকায় তুলে নাও।

চাষা/ কৃষাণ

সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, 
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা। 
দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিল বড়? 
পুণ্য অত হবে নাক সব করিলে জড়। 
মুক্তিকামী মহাসাধক মুক্ত করে দেশ, 
সবারই সে অন্ন জোগায় নাইক গর্ব লেশ। 
ব্রত তাহার পরের হিত, সুখ নাহি চায় নিজে, 
রৌদ্র দাহে শুকায় তনু, মেঘের জলে ভিজে। 
আমার দেশের মাটির ছেলে, নমি বারংবার 
তোমায় দেখে চূর্ণ হউক সবার অহংকার।